মুসলিম বিশ্বে ক্যালিগ্রাফি বিশেষভাবে সমাদৃত। তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি দীর্ঘ শতাব্দী ধরে সেদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রধান অংশ। কিন্তু আধুনিক যুগে এর সৌন্দর্য অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। তবে এই ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখার চেষ্টা করছেন রুমেয়সা কুরতুলুস নামের এক নারী। এ নিয়ে লিখেছেন ফারজানা ফাহমি
তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি দীর্ঘ শতাব্দী ধরে সেদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রধান অংশ। ‘শব্দ উড়ে যায়, লেখা থেকে যায়’-এই প্রবাদটি তুরস্কে ক্যালিগ্রাফির স্থায়িত্ব ও গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। একসময় এই শিল্প রাজপ্রাসাদ, মসজিদ এবং পাণ্ডুলিপিকে অলংকৃত করত, কিন্তু আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপন, ডিজিটাল স্ক্রিন ও নিওন সাইনের ভিড়ে ক্যালিগ্রাফি অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবে এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি শিল্পের নব পথিকৃৎ রুমেয়সা কুরতুলুস।
ক্যালিগ্রাফিকে বলা হয় জীবন্ত শিল্পকলা। এর সৌন্দর্য, অঙ্কন পদ্ধতি, উপস্থাপনা ও লিপিশৈলীর গভীরতা যেকোনো মানুষকে মোহিত করে। ক্যালিগ্রাফি এমন শিল্পকে বলা হয়, যাতে চমৎকার সব অক্ষর, শব্দ, প্রতীক ইত্যাদিকে নিখুঁত ও সুন্দর আয়োজনে সাজানো হয়। শব্দ ও হরফের নানা বাঁক সৃষ্টির দক্ষতা, কৌশল ও ভিন্নধর্মী সৃজনশীল নকশা ক্যালিগ্রাফির মূল আকর্ষণ। এ কারণে গবেষকরা আরবি ক্যালিগ্রাফিকে ‘লিভিং আর্ট’ বা জীবন্ত শিল্পকলা বলে অভিহিত করেছেন।
আরবি বর্ণমালাকে কেন্দ্র করে ইসলামি লিপিকলার উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ। আরবি ভাষা ও সংস্কৃতি, আরবি লিপি-বর্ণ হরফ-জের-জবর-পেশের সঙ্গে মুসলমানদের আলাদা আবেগ-অনুভূতি মিশে আছে। অন্যদিকে ইসলামে মানুষ কিংবা প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই লিপিকলানির্ভর অলংকরণশৈলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।
ইংরেজি ক্যালিগ্রাফি শব্দটি গ্রিক ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে এসেছে। গ্রিক শব্দ ক্যালোস এবং গ্রাফেইনের মিলিত রূপ ক্যালিগ্রাফিয়া। ক্যালোস অর্থ সুন্দর, আর গ্রাফেইন অর্থ লেখা। সহজে ক্যালিগ্রাফির পরিচয় এমন, ‘বর্ণ বা শব্দ ব্যবহার করে চমৎকার লিখনশিল্পকে ক্যালিগ্রাফি বলে।’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, ভাষা এবং ধর্মের লোকরা সানন্দচিত্তে ক্যালিগ্রাফির চর্চা করেন।
বিভিন্ন ভাষার হরফে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। আরবি, ইংরেজি, চীনা, জাপানি ও বাংলা প্রভৃতি ভাষার হরফের ক্যালিগ্রাফি মানুষকে মোহিত ও আনন্দিত করে। ইদানীং হ্যান্ডরাইটিং, টাইপোগ্রাফি, পিক্টোগ্রাফিসহ নানা ধরনের রাইটিংকে নির্দ্বিধায় ক্যালিগ্রাফি বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া অ্যাম্বিগ্রাম, মনোগ্রাম, লেটারিং ইত্যাদিও ক্যালিগ্রাফি হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
ইস্তাম্বুলের উস্কুদারে নিজের ক্যালিগ্রাফি স্টুডিও ‘কেবিকেচ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাত্র ২৬ বছর বয়সেই কুরতুলুস ক্যালিগ্রাফি শিল্পে নতুন জীবন আনতে শুরু করেন। তার কাজ শুধু ব্যক্তিগত শিল্পীসত্তার প্রকাশ নয়, বরং তুরস্কের ঐতিহ্য রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এই সংস্কৃতিকে তুলে ধরার মাধ্যম।
তুরস্কের ক্যালিগ্রাফি চর্চার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর এটি আরও সমৃদ্ধ হয়। তবে ১৯২৮ সালে তুরস্কে লাতিন বর্ণমালা চালুর ফলে আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রভাব কমতে থাকে এবং এখান থেকেই আধুনিক তুর্কি ক্যালিগ্রাফির নতুন শাখার জন্ম হয়। এমিন বারিন ছিলেন এই পরিবর্তনের অগ্রদূত। তিনি আরবি ক্যালিগ্রাফির নান্দনিকতাকে লাতিন শৈলীর সঙ্গে একত্রিত করে এক নতুন ধারা তৈরি করেন।
কুরতুলুসও তার ক্যালিগ্রাফি শৈলীতে ঐতিহ্যগত কুফিক স্ক্রিপ্ট, লাতিন ক্যালিগ্রাফি ও আধুনিক ডিজাইনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে তার সৃষ্টি ‘শব্দ উড়ে যায়, লেখা থেকে যায়’ এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে তিনি তুরস্কের বর্ণমালা সংস্কারের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তার কাজে আরবি ও লাতিন অক্ষরের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায়, যা কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং ঐতিহাসিক সংযোগও তুলে ধরে।
তার শিল্পীসত্তা শুধু সৃজনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।কুরতুলুসের আর্কিটেকচারাল শিক্ষার প্রভাব তার কাজে স্পষ্ট। তিনি ক্যালিগ্রাফিকে শুধুই অক্ষরের নকশা হিসেবে দেখেন না, বরং স্থাপত্যশিল্পের মতোই এটি একটি কাঠামোগত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেন। তার মতে, ক্যালিগ্রাফি শুধু শিল্প নয়, এটি একটি সভ্যতার সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির প্রতিচিত্র।
২০১৭ সালে তার প্রথম প্রদর্শনী ‘রেঞ্জ খোদা’ দর্শকদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে। এটি ছিল একটি মাল্টি-সেন্সরি প্রদর্শনী, যেখানে শুধু চোখ নয়, স্পর্শের মাধ্যমেও শিল্পকর্ম অনুভব করা যেত। বিশেষ করে, একটি ব্রেইল ক্যালিগ্রাফি কাজ ‘আল্লাহ’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যা তাদের প্রার্থনার অনুভূতিকে বাস্তবে রূপ দেয়।
কুরতুলুসের কাজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ২০২৩ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রোমান হলিডে কনফারেন্সে অংশ নেন এবং প্রথম তুর্কি ক্যালিগ্রাফার হিসেবে সম্মাননা স্বরূপ ‘ড্যান্সিং লেটার্স’ স্কলারশিপ অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি তার স্টুডিওতে নিয়মিত কর্মশালা পরিচালনা করছেন, যেখানে নতুন প্রজন্মকে ক্যালিগ্রাফির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তার কাজ শুধু ঐতিহ্য সংরক্ষণই নয়, বরং এটি একটি নবজাগরণ। রুমেয়সা কুরতুলুস প্রমাণ করেছেন যে ক্যালিগ্রাফি শুধু অতীতের স্মারক নয়, বরং এটি একটি প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল শিল্পধারা, যা সময়ের সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে।